বিষকন্যা
-শচীদুলাল পাল
বিষকন্যা এমন এক নারী, অতিসুন্দরী হলেও জুটতো না ঘর।
বরও যদি ভাগ্যে জুটতো
তা ক্ষণিকের জন্য। গনকের গননায় যার কুষ্টিতে বৈধব্য যোগ থাকতো তাকেই বিষকন্যা করা হতো। কারন তিনি বিষকন্যা হবার উপযুক্ত। রাজা রাজড়ারা নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিষকন্যা ধীরে ধীরে তৈরি করতো।
প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন সময়ের গল্প-উপকথা-ইতিহাসের ভাণ্ডার নিয়ে মানুষের মনে কৌতূহলের শেষ নেই। আর সে কৌতূহলেই বিভিন্ন সময় আমরা খুঁজে পাই বিভিন্ন আকর্ষণীয় চরিত্র। তার মধ্যে অন্যতম ‘বিষকন্যা’।
এই ললনাদের দেহের শিরা-ধমনী বেয়ে রক্তের সঙ্গে প্রবাহিত হতো বিষ। তাদের সঙ্গে সম্ভোগ তো দূরের কথা, সামান্য স্পর্শেই মৃত্যু অনিবার্য। বিনা যুদ্ধে শত্রুবিনাশে আগুন ধরানো এই সুন্দরীদের ব্যবহার করতো রাজা-মহারাজা-সম্রাটরা। কল্কিপুরাণ, শুকসপ্ততী এবং চাণক্য রচিত অর্থশাস্ত্রে একাধিকবার এসেছে বিষকন্যাদের কথা। গন্ধর্ব চিত্রগ্রীবার স্ত্রী সুলোচনা ছিলেন এক বিষকন্যা।
শুধু ভারতীয় সভ্যতাই নয়। অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতাতেও উল্লেখ আছে বিষকন্যাদের কথা। সভ্যতার আদিপর্বের সেই সমাজে নির্দিষ্ট করে বেছে নেয়া হতো মেয়েদের। তখনকার রীতি অনুযায়ী গণকের ভাগ্য গণনায় যদি দেখা যেত, সাধারণের ঘরের পরমা সুন্দরী কোনো মেয়ের ভাগ্যে বৈধব্যযোগ আছে,তবে তাদের আর স্বাভাবিক জীবনে থাকতে দেয়া হতো না। রাজা বা শাসকদের লোকজন তাদেরকে পরিবার থেকে আলাদা করে নিয়ে আসতো।বিচ্ছিন্ন জীবনে বরাদ্দ হতো বিশেষ পথ্য। শিশু বয়স থেকে তাদের দেহে প্রবেশ করানো হতো তিল তিল করে বিষ।
প্রথম প্রথম বিষফল খেতে দেওয়া হতো।তারপর একটু একটু করে বিষের মাত্রা বাড়িয়ে দেওয়া হতো। সব রকম বিষ যখন রক্তে ধারন করতে সক্ষম হতো তখন কন্যাটিকে জীভে বিষধর সাপের ছোবল গ্রহন করতো।
বিষে বিষক্ষয় অনিবার্য। বিষয়টা তাদের জন্য সহনীয় হয়ে যেত। পরে তাদের কেউ বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করতে পারত না। কিন্তু তারা কারোর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হলে সঙ্গী পুরুষটির মৃত্যু হতো। ইংরেজিতে একে বলা হয় মিথ্রিডাটিজম
নন্দরাজার মন্ত্রী এক বিষকন্যাকে পাঠিয়েছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে হত্যার লক্ষ্যে। কিন্তু চাণক্যের কূটবুদ্ধিতে চন্দ্রগুপ্তের বদলে সে হত্যা করে বসে পর্বতককে।
অনেক ক্ষেতে শুধু সঙ্গম বা স্পর্শ বা দৃষ্টি নয়,এই সুন্দরীরা মদিরায় বিষ মিশিয়ে বধ করত শিকারকে। সাহিত্য, চলচ্চিত্রে ঘুরে ফিরে এসেছে বিষকন্যা বা পয়জন গার্লের প্রসঙ্গ।
পুরুষের ইচ্ছেতে, অঙ্গুলি হেলনে কন্যারাই বহন করেছেন বিষ। পঙ্কিল ষড়যন্ত্রের বিষ ধারণ করার জন্য নারীরাই ভাল আধার! তবে অনেক আখ্যানে বিষকন্যার কথা বলা আছে যা সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে সত্য হিসেবেই। অনেকের মতে, অতিরঞ্জিত হলেও বিষকন্যার বাস্তবতা ছিল।
কোনো এক রাজ্যে
রাজ্যের বাছাই করা সদ্যোজাত শিশুকন্যাদের নিয়মিত বিষ খাওয়ানোর আদেশ দিলেন এক রাজা। এক জন ছাড়া মারা গেল তাদের সকলেই। আর প্রতিদিন বিষপানে বেঁচে থাকা সেই একটি মেয়ে এক সময়ে হয়ে উঠল চোখ-ধাঁধানো সুন্দরী এক বিষকন্যা।
এক দিন দলবল-সহ যুদ্ধে বন্দি হয়ে, বিষকন্যাকে শত্রু শিবিরে বীণা বাজাতে পাঠালেন আক্রান্ত রাজা। সেই মেয়ের রূপ যেন এক আগল ভাঙা প্লাবন! মুগ্ধ শত্রু-রাজা তাকে ডাকলেন নিজস্ব আড়ালে। তার পরে যেই তাকে কাছে টেনে তার ঠোঁটে রাখলেন অধৈর্য চুম্বন, মারা গেলেন নিজে।
ষোড়শ শতকের এক ফরাসি আখ্যানে পাওয়া যায় এই গল্প। গবেষকেরা মনে করেন, খ্রিস্টের জন্মের আগেই বিষকন্যা ধারণার উৎপত্তি ভারতে, পরে তা ছড়িয়ে যায় বিশ্বের অন্যত্র। সম্ভোগের প্রখরতায় বিষকন্যারা সরাসরি রক্তে ঢেলে দিত বিষ। কখনও তাদের ঘাম অথবা দৃষ্টি, কখনও শুধু নিশ্বাসেই মৃত্যু ছিল অনিবার্য।
‘অৰ্থশাস্ত্র’ প্রণেতা চাণক্যও রাজাকে সাবধান করে বলেছিলেন, অচেনা রমণীদের ব্যবহারের আগে ধুয়ে নিতে হবে তাদের উরু। কারণ হতেই পারে, তারা বিষকন্যা!
চন্দ্রগুপ্তকে বিষ খাওয়াতেন চাণক্য
জঙ্গলে বন্ধুদের সঙ্গে এক বালককে রাজা-রাজা খেলতে দেখে নিজের লক্ষ্য স্থির করে ফেললেন চাণক্য। দাম্ভিক, প্রজা-বিদ্বেষী রাজা ধননন্দের মুখে নিজের অপমানের বদলা নিতে সেই বালককেই ভবিষ্যতের মগধ অধিপতি হিসেবে তৈরি করলেন তিনি। তার পরে এক দিন ধননন্দকে যুদ্ধে হারিয়ে পাটলিপুত্রের সিংহাসনে চাণক্য এগিয়ে দিলেন প্রিয় শিষ্য চন্দ্রগুপ্তকে। চার পাশে চন্দ্রগুপ্তকে হত্যার চক্রান্তের আভাস পাচ্ছিলেন চাণক্য, যার মধ্যে বিষের আক্রমণের সম্ভাবনাই ছিল প্রবল। প্রজ্ঞা আর চতুর কৌশলে চন্দ্রগুপ্তকে আগলে রেখেছিলেন চাণক্য, আর তাঁর খাবারে প্রতিদিন গোপনে সামান্য বিষ মিশিয়ে দিতেন তিনি। তিনি জানতেন, বিষের আক্রমণ থেকে বাঁচতে এ ভাবেই এক দিন তৈরি হয়ে উঠবে চন্দ্রগুপ্তের শরীর।
দৈববাণী অনুযায়ী যে বসুদেব – দেবকীর অষ্টম গর্ভজাত সন্তান রাজা কংসকে হত্যা করবে,
সে গোকুলে লালিত পালিত হচ্ছে,এরূপ এক দৈববাণী শুনে রাজা কংস দশ বারো দিন বয়সী সব সন্তানকে মেরে ফেলতে পুতনা রাক্ষসীকে পাঠিয়েছিল। পুতনা ইচ্ছেমতো তার রূপ পরিবর্তন করতে পারত। সুন্দরী বধূ সেজে স্তনদান করে শিশুদের মারতে গিয়েছিল। সে যখন বসুদেব- দেবকীর পুত্র কৃষ্ণ কে মারতে স্তনদান করতে গেলো অন্তর্যামী কৃষ্ণ বুজতে পেরে পুতনার স্তনকে এমনভাবে চুষে নিষ্পেষিত করেছিল তাতে তীব্র বিষ জ্বালায় ছটফট করতে করতে পুতনার মৃত্যু হয়েছিল।এই পুতনা ছিল বিষকন্যা।
এলোমেলো ভাবে প্রাচীন ভারতের কিছু আখ্যানে ছড়িয়ে আছে বিষকন্যাদের কথা। তার অন্যতম হল, সোমদেব ভট্টের ‘কথাসরিৎসাগর’। শৈশব থেকে প্রতিদিন অল্প অল্প বিষপানে পালিতা বিষকন্যাদের ব্যবহার করা হতো মূলত রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আর গুপ্তহত্যার প্রয়োজনে। লালসার বশে বিষকন্যাদের দুর্নিবার আবেদনে সাড়া দিলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেন ক্ষমতাবান রাজপুরুষেরা। কখনও নাচের দলে, কখনও বা উপহার হিসেবে, এই সব বিষকন্যাদের শত্রু শিবিরে ঢুকিয়ে দিত চতুর প্রতিপক্ষ. তার পরেই শুরু হয়ে যেত তাদের বিষের ছোবলে কাঙ্ক্ষিত হত্যার খবর আসার অধীর প্রতীক্ষা।
বিশাখদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটক, এমনকী, কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ থেকে জানা যায়,
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে যখন অঙ্গ, কোশল, কাঞ্চী, অবন্তী ইত্যাদিকে ছলনায় পরাভূত করে মগধের প্রবল উত্থান ঘটছিল। তখন বিষকন্যারা উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করতেন। বিশেষত, নন্দ বংশের আমলে রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। সেই সময়ে রাজা ও রাজপুরুষদের হত্যা করে গোলযোগ তৈরি ছিল এক নৈমিত্তিক ঘটনা।
উপসংহার
—————————————-
‘বিষকন্যা’ শব্দটিকে আক্ষরিক অর্থে না-দেখলে অন্য কিছু দ্যোতনা প্রতীয়মান হয়। এমনটাই বলে গিয়েছেন কৌটিল্য বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্য। ভারতের সর্বত্র প্রচলিত ‘চাণক্য নীতি’-তে জানানো হয়েছে, ‘বিষকন্যা’ শব্দটি অনেক সময়েই একটি অভিধা এবং যুগে যুগে বিষকন্যারা পুরুষের সর্বনাশ করতে সক্রিয় থাকেন। অথবা পুরুষের লালসাই অনেক সময়ে সাধারণ নারীকেও ‘বিষকন্যা’ করে তোলে।